বাঁশখালীর পাখি

-----
আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে পাখিবালা শীল ৬৫ বছরের জীবন কতো কিছুই না দেখেছে দুর্ভিক্ষ, খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, আর সর্বোপরি৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ খোলা আকাশের নিচে বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রোমান্টিক কোন কবিতার লাইন মনে ভেসে ওঠে না তার বরং নরম মোলায়েম চাঁদটাকে কেন যেন একটু পোঁড়া পোঁড়া মনে হয় চোখেরই ভুল হয়তো বয়েস তো একেবারে কমও হয়নি পাখিবালার মনে পড়ে যায় স্বামীর কথা মাত্র তেরো বছর বয়েসে তার বিয়ে হয় ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে মুখে নাম আনতে না পারলেও, স্বামীর চেহারা ঠিকই এতো বছর পরেও উজ্জ্বল পাখির কাছে আর থাকবে নাই বা কেন প্রেম কাকে বলে, তা তো বুঝতোই না তখনও আর তাই স্বামীর খুনসুটি, আদর-আহ্লাদ, সবই তার কাছে খেলা মনে হতো আর বোকাসোকা ভালো মানুষ স্বামী নিতাই শীলও সেটি বুঝতে পেরে আরো বেশী করে যেন খেলায়ই মেতে উঠতেন বউটির সাথে

হঠাৎ মনের অজান্তেই হাসি চলে আসলো পাখিবালার মুখে একদিন হয়েছিল কি? আশেপাশে তাকিয়ে দেখলেন পাখিবালা কেউ দেখছে না তো আবার বুড়ো বয়েসে অন্ধকারে একা একা খোলা আকাশের নিচে বসে হাসাটা ঠিক ভালো লক্ষণ নয় যাই হোক একদিন নিতাই এসে তাকে বললেন, ‘জানো পাখি? তোমারে আইজ চান্দে দেখসি চাঁদ আর মেঘের দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন কিছু কল্পনা করা পাখির খেলার অংশ হলে স্বামীর এই কৌতুক মেনে নিতে চাননি তিনি যাহ, চান্দে আবার মানুষ দেখা যায় না কি!’ স্ত্রীর নিষ্পাপ এই অবিশ্বাস নিতাইকে বাধ্য করেছিল অট্টহাসিতে রাত্রির নীরবতা খানখান করে ভেঙ্গে দিতে


পাখি ভেবেছিল সেই সুখ বুঝি চিরকাল একই রকম থাকবে আর ঠিকই তো ঝড়, বন্যা, খরা, এমনকি প্রচণ্ড আকালে খাবারের টানাটানির সময়েও ঠিক একই রকম ছিল পাখির সংসার খাবারের অভাব বলতে গেলে বুঝতেই হয়নি তাদের তবে একসময় নিতাইকে খুব চিন্তিত দেখা গেলো শহরে নাকি কি সব হচ্ছে, নিতাই নিজেও ঠিকমতো বুঝতে পারছেন না, পাখিকে কি বুঝাবেন তবে এটা বুঝতে পারছিলেন, যা নিয়েই হোক, গন্ডগোলটা বেশ বড় আকারেই হচ্ছে যতো দিন যেতে লাগলো বিষয়টা বাঁশখালীতে ততোই পরিস্কার হতে লাগলো পাকিস্তানিরা বাঙ্গালীরে শেষ করে দিতে চায়, যুদ্ধ ডেকেছে শেখ মুজিব দুই এক দিন পর দলে দলে লোক আসতে লাগলো বাঁশখালীতে কেউ পরিচিত, কেউ অপরিচিত, কেউ আত্মীয়, কেউ কোথায় যাচ্ছে জানে না, শুধু জানে, নৃশংসতা থেকে পালিয়ে যেতে হবে অনেক দূর তাদের কাছ থেকে জানা গেলো, ২৫শে মার্চ থেকে পাকসেনারা নির্বিচারে বাঙ্গালী খুনের উৎসব শুরু করেছে ঢাকার উৎসব শেষ করে তারা এখন ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামে গ্রামে শুধু হিন্দু না, হত্যায় পাকিরা বৈষম্যহীন পরিচয় একটাই, বাঙ্গালী

নিতাইরাও প্রস্তুত গ্রামের সবাই, ছেলে-বুড়ো, হিন্দু-মুসলমান, নারী-পুরুষ, সবাই মিলে ঠিক করলেন, পালানো যাবে না, কোথায়ই বা যাবেন পালিয়ে হবে পাহারা, হবে প্রতিরোধ তৈরী হলো প্রতিরোধ কমিটি প্রতি রাতে জনা পঞ্চাশেক গ্রামবাসী লাঠি-সড়কি-বল্লম-রামদা নিয়ে টহল দিল গ্রাম বুকের সাহসেই আধুনিক অস্ত্রে বলিয়ান পাকসেনাদের রুখে দেয়ার প্রত্যয় পাহারার রাতগুলোও বেশ ভালোই কাটছিল প্রতি রাতেই লুকিয়ে স্বামীর সাথে দেখা করে আসত পাখি নিতাইর জন্য মুড়ি-মুড়কি, পিঠা নিয়ে খাইয়ে আসতো তবে একদিন অন্যদের কাছে ধরা পরে সে কি লজ্জা সবাই খুব হাসাহাসি করলো দুইজনকে নিয়ে তাতে অবশ্য লাভই হয়েছিল এরপর আর লুকিয়ে না গিয়ে সবার জন্য খাবারদাবার নিয়েই যেতেন টিটকারি দিতে অবশ্য কেউ ছাড়তো না ঠাট্টার সম্পর্কের সবাই নিতাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতো, ‘ যে, তোমার রাতজাগা পাখি আইতাছে

তারপর এলো এক ভয়ঙ্কর রাত ঘটনাগুলো এখন দ্রুত ঘটতে থাকে পাখির মাথায় প্রতিরাতের মতো মাত্র খাওয়া শেষ করে নিতাইরা বিড়ি ধরিয়েছে আয়েশ করে দুটো টান দেয়ার জন্য খবর এলো পাকসেনারা ঢুকেছে গ্রামে   করে রণহুংকার তুলে গ্রামের সবাই দৌড়ে গেলো ট্যাংক-কামানের পরোয়া না করে, বাঁচাতে হবে গ্রাম, পরিবার বিশাল ধানক্ষেত থেকে রাস্তায়ও উঠতে পারলো না তারা এতো গুলি সারাজীবনে একসাথে শুনেনি পাখি আর কোনদিন শুনতেও চায়না শুধু মনে আছে ঝড়ে পাকা আমের মতো টপটপ করে ক্ষেতে পরে গেলো সবাই পাখি দৌড়ে বাড়িতে গিয়ে কোলের ছোট্ট বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কোন রকমে পৌঁছালো পাশের জঙ্গলে তারপর শুধু আগুন, চিৎকার আর গুলি আর ভাবতে পারছে না পাখি রাতের অন্ধকার তার চোখে আরো ঘন হয়ে এলো








-----
এই ধানক্ষেত, এই নিঝুম রাত, সবকিছুই হঠাৎ খুব অচেনা লাগে শম্ভুর কাছে জঙ্গলে ঘাপটি মেরে বসে থাকতে থাকতে চোখের সামনেই যেন সবকিছু পালটে যায় তখন খুব ছোট্ট শম্ভু কতো আর? পাঁচ-ছয় বছরে হবে হয়তো এই তো, এখান থেকে চার-পাঁচ হাত দূরে বসেছিল বাবা তার কোলে শম্ভু আর আশেপাশে মা সহ গ্রামের অন্যরা বেশীকিছু মনে না থাকলেও এটুকু মনে আছে, কখনও সবাই খুব হাহাহা করে হেসে উঠতো, আবার কখনও শ্মশানের মতো নীরব বাবার হাতে থাকতো একটা রামদা পূজায় মাঝে মাঝে যখন বলি দেয়া হতো, তখন এই রামদা সাথে নিতো বাবা বাবার অনেক শক্তি, ছোট্ট শম্ভুর খুব অবাক লাগতো এক কোপে কিভাবে মহিষের মাথা আলাদা করে ফেলতো কিন্তু এখন রামদা নিয়ে কি করে বাবা? শুনেছে কতগুলো শয়তান মানুষ আসবে, তাদের মারতেই এই রামদা রাজ্যের সব আগ্রহ নিয়ে সে বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এটা দিয়া মানুষ মারবা বাবা?’ বাবা বলেছিলো, ‘মানুষ না রে অনেক বড় বড় কিছু জানোয়ার আইবো, তাগোরে মারতে অইবো এইডা দিয়াআমিও মারি?’, ভারী রামদা দুইহাতে তোলার চেষ্টা করতে করতে বলে শম্ভুমারিস বাপ আমি না পারলে মারিস এই ছিল বাপের সাথে তার শেষ কথা

তার বাপ পারেনি কথা শেষ হওয়ার আগেই পাকসেনারা ঢুকে পড়ে বাঁশখালীতে জানোয়ারদের গায়ে একটা আঁচড় দেয়ার আগেই গুলিতে মারা যায় বাবা তবে আরো লাখ লাখ শম্ভুর বাপ পেরেছিলো যুদ্ধ করে নতুন একটা দেশ বানিয়ে ফেলেছে বাঙ্গালীরা হঠাৎ সারা শরীর কেঁপে উঠে শম্ভুর আরে, শত্রু তো সেই একই ওরাও তাহলে মরে যায়নি, দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে রেখে গেছে বিষাক্ত বীজ স্বাধীন হওয়ার যে আশা নিয়ে তার বাপ জীবন দিয়েছিল, সেই স্বাধীনতা আবারো কেড়ে নিতে চায় পাকিস্তানের দোসররা? এতোই সাহস তাদের, এতোই শক্তি তাদের যে আবারো পাকিদের মতো বাড়িঘরে হামলা চালাতেও পিছপা হয়না তারা? এতো নরম কেন বাঙ্গালীর মন? বারবার মরেও শিক্ষা হয় না? শত্রুকেও কেন ছেড়ে দেয় বারবার, কেন ফিরে ফিরে আসে৭১? ভয় ধরে যায় শম্ভুর মনে, সে পারবে তো?

দৌড়ে ঘরে গিয়ে বউয়ের কোল থেকে সাত বছরের অমলকে নিজের কোলে নেয় শম্ভুআমি না পারলে তুই পারবি তো বাপ? তুই কিন্তু ছাড়িস না’ ‘পারমু বাজান, আমি ছাড়মু না’, হয়তো বুঝে, হয়তো না বুঝেই জবাব দেয় অমল কিন্তু শম্ভু জানে, একদিন ঠিকই বুঝে ফেলবে অমল শম্ভু না পারলেও অমল পারবেই চল বাইর থাইক্যা ঘুইরা আসি পেছন পেছন রওয়ানা হয় শম্ভুর বউ নীপু শিলও কথা হয় চোখে চোখে, যুদ্ধের ভাষায়


-----

(গল্পের চরিত্র কাহিনী প্রায় পুরোটাই কাল্পনিক হলেও, ইতিহাস কাল্পনিক নয়, যুগযুগান্তের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিজাতীয় গালভরা কথা পাখিরা জানে না কিন্তু তারা জানে এর মূলতত্ত্ব তারা এও জানে, ‘পিপীলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে তারা প্রমাণসহ জানে এই প্রবাদ যুগযুগান্ত ধরে নিজের সত্যতা প্রমাণ করেছে, ’৭১-এও, করবে১৩ তেও শত দুঃখেও, খোলা আকাশের নিচে বসে্, তাই পাখির মুখে হাসি হাসি সুখের নয়, আনন্দের নয়, দুঃখেরও নয়বিদ্রুপের বিদ্রুপ তাদের প্রতি, যারা বারবার চেষ্টা করেও, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েও ধ্বংস করতে পারেনি বাঁশখালীর পাখিদের)

আসল ঘটনাঃ  গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আর্ন্তজাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের নায়ে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসীর রায় ঘোষণার পর বাঁশখালী জুড়ে তান্ডব সৃষ্টি করে জামায়াত-শিবির বাঁশখালীকে দুভাগে ভাগ করে দক্ষিণ থেকে আসা জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা উপজেলা কমপ্লেক্স, আদালতে আগুন দেয়, আক্রমণ করে থানা, পুড়িয়ে দেয় হিন্দু মালিকানাধীন দশটি দোকান আর বাঁশখালীর উত্তরের জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে, টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করে

কয়েক ঘন্টা তাণ্ডব চালানোর পর জনতার ধাওয়া খেয়ে পালানোর সময় জামায়াতি দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয় দশটি ঘর মেয়ে নীপু শীলের স্বামীর বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন দয়াল হরি বাজার থেকে খাবার কিনে এনেছিলেন, অপেক্ষা করছিলেন রান্না হওয়ার জামায়াতিরা বাড়িতে আগুন দিলে দয়াল দৌড়ে বের হন আগুন নিভাতে প্রথমে ইট দিয়ে আঘাত করে দয়াল হরির মাথা ফাটিয়ে দেয় তারা প্রাণ বাঁচাতে পাশের পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়েন দয়াল সেই পুকুর থেকে টেনেহিঁচড়ে এনে কুপিয়ে হত্যা করা হয় দয়াল হরিকে

তাণ্ডব হতে পারে এমন ধারণা আগে থেকেই করা গেলেও প্রস্তুতি নেয়নি প্রশাসন হামলার সময় তাৎক্ষণিকভাবে এগিয়ে আসেনি পুলিশ এলাকায় উপস্থিত থাকলেও ঘটনার দশদিন পরও ঘটনাস্থলে যাননি স্থানীয় সংসদ সদস্য বিএনপি নেতা জাফরুল ইসলাম


0 Responses

Post a Comment