নষ্ট রিক্সাওয়ালা
ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, মঙ্গলবার
        আমার নাম শরিফুল ইসলাম আমি কিলাস ফাইব পরযন্ত পইড়ছি পরালেকা বুইলা গেসি সব কিসু আমার গেরাম গাইবান্দার সুন্দরগঞ্জের পরাণ গেরাম সাত বচ্চর ঢাকায় থাহি আববা ডেইলি কাজ করে, আমমা ছুটাবুয়া দুইজনেই ঢাকাত বাড়িত একটা বউ আসে একটা ছাওয়াল আসে আইজ হরতাল সন্দায় সাবাগে গেলাম, বারসিটির পনচাস-সাইটটা মামা রাস্তা বন্দ কইরা দিসে রাজাকার কাদের মুল্লার ফাসি অয় নাই, তাই রাস্তা বন্দ তারা ফাসি চায় কিসুখন চায়া দেখলাম, পরে ঘুইরা অন্য রাস্তা দিয়া গেলাম গেরেজে মমিনুল কইলো ভাত পাই না ফাসি চায়

ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, বুধবার
        আইজকাও হরতাল অনেক লাব অইসে দুপুরের আগে দুই হাযার টেকা কামাইসি রিস্কা টাইনা টাইনা বুইলাই গেসিলাম সাবাগের কতা দুপুরে যাইতে গিয়া দেকি রাস্তা বন্দ চায়ের দোকানে রিস্কা রাইখা গিয়া দেকি ওরে আল্লা আইজকা কয়েক হাজার মানুস মাইক লাগাইসে খালারাও সলুগান দিতাসে মজা লাগল রাজাকারের হরতাল মানিনা মানিনা পরে আমিও দিলাম জয় বাংলা দিতাসিল আমি দেই নাই

ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, বৃহস্পতিবার
        আমি ভাবসিলাম, দুইদিন হরতাল, রাস্তায় গারি নাই, তাই পুলিস পিটায় নাই আইজকা সাবাগে পিডাইবো আমি আর যাই নাই টিপ নিয়া অনেক দূর গেসিগা সাবাগ আসি নাই পরে রাইতে গেরেজে মমিনুল কইলো আইজকা আরো বেশি মানুস অইসিলো গেসিলো আমি কইলাম ভাত পাই না, ফাসি চায়

ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, শুক্রবার
        রাইতে মমিনুল কইসিলো আইজ তিনটায় মিটিং ডাকসে তারাতারি বাইরইসি আটটার সময় জুমার নামায পরযন্ত গারি চালায়া নামায পইরা আমি আর মমিনুল সাবাগ গেলাম পুলিশ রুপসি বাঙলার সামনে রাস্তায়  গারি বন্দ কইরা দিসে আমার মাতা গুরায়া গেসে লাখ লাখ মানুস এতো মানুস কইথ্যাইকা আইলো বাসা থাইক্কা বুরা, পিচ্চি, মাইয়া সবাই আয়া পরসে সলুগান শুইনা আমার লুম খারায়া গেল আমি জয় বাংলা দিয়া দিলাম মমিনুলও পরে মাইকে এক খালা কইল, যুদ্দের সময় সবাই জয় বাংলা বলসে, এইডা সবার, কুনু দলের না অনেক রাইতে গেরেজে আইসি


ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, শনিবার
        আইজকা আরামে গুমাইসি উইঠা গুসল কইরা খায়াদায়া হেরপরে বাইরাইলাম রিস্কা লয়া ধানমনডি সাতাইস নামবারে এক মামা মাতায় পতাকা বান্দা আমারে ডাইকলো সাবাগ যাবা? আমি কইলাম উডেন ভারা জিগাইল আমি কইলাম উডেন আগে মামা গলপ সুনাইল কেন রাজাকারের ফাসি চায় আমার বারির গলপ সুনল কইল দেস সাদিন অইসে আপনেরা গরিবরা না খায়া থাকবেন কেন? সাবাগ গিয়া ভারা নিলাম না অনেক জুর করল মামায় আমি কইলাম মামা আমিও ফাসি চাই চলেন সলুগান দেই মামা আমারে জরায়া দরল পতাকা কিইনা দিল আমরা সলুগান দিলাম জয়বাংলা

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, বৃহস্পতিবার
       তিনদিন কিসু লেখতে পারিনাই অনেক কাজ করসি আমি রানবার পারি সুইনা আমারে মামা-খালারা চানদা তুইলা টেকা তুইলা দিল বিসাল বিসাল ডেগচিতে খিচুরি রাইনদা খাওয়াইলাম মাজে মাজে টাইম পাইলে রিস্কা লয়া গুইরা কিসু টেকা নিয়া আইতাম আবার আইবার সময় খুইজা কুনু সাবাগ মামা-খালারে নিয়া আইতাম
        যাউকগা আইজ ভালবাসা দিবস সকালে বাইরায়া দেকি মামা-খালারা সাজুগুজু কইরা মাতায় ফুল লাগায়া হাত দইরা গুরতাসে অনেক গুইরাও কাউরে সাবাগ যাবে মনে অইল না ভালবাসার দিনে জয় বাংলারে ভুইলা গেল? পরে এক মামা ডাকল সাথে খালা আমারে কইল সাবাগ চলেন গিয়া দেখি ওরে খুদা সবাই সাইজাগুইজা সাবাগেই আয়া পরসে মামা-খালারা দেখি হাত দইরা সলুগান দিতাসে রাইতে কয়েক লাক মানুস একসাতে মমবাততি জালাইল আমিও জালাইসি মনে অইতাসিল সাবাগে আগুন জলতেসে আনন্দে আমার চুখে পানি আয়া পরল

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, শুক্রবার
        সকালে উইটা রিস্কা চালাইসি জুমা পরা সাবাগ গেসি সমাবেস অইল আইজকা অখন থাইকা পরতেক দিন তিনটা থাইকা দসটা পরযন্ত আন্দুলন অইব মন খারাপ অইসে দসটায় আয়া পরসি

১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, শনিবার
        সাবাগ গিয়া সুনি কাইলকা এক বলগার মামারে মাইরা ফালাইসে আমার রক্ত গরম হয়া গেল আমি কইলাম চলেন মগবাজার, জামাতের অফিস জালায়া দেই সবাই মিলা থামাইল আইজকা আর লিখুম না
       
১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, রবিবার
আইজকা রিস্কা থাইকা এক বুরারে নামায়া দিসি মুহাম্মদপুর যাইব দুইজন রিস্কায় উঠসে একজন আরেকজনরে কয় সাবাগ গেলে টেকা দেয় খাওন দেয় এর লাইগা সবাই যায় আমি রাইগা গেলাম রিস্কা গুরায়া সাবাগ গেলাম আমারে কয় কই যাও, আমি কইলাম আপনের অফিস করতে অইব না সাবাগ চলেন অইখানে টেকা দেয় আমি ঘামের টেকা দিয়া মামা-খালাগরে খাওয়াই আপনে কন মাগনা খাইতে সাবাগ যায় সাবাগ চলেন নাইলে নামেন হাইটা যান অরা মারতে আইল আমি পাসের দুকান থাইকা দা নিলাম সবাই জিগায় কি অইসে আমি কইলাম সাবাগ নিয়া গালি দিসে কয় গেলে টেকা পাওয়া যায় কয়েক জন মারতে গেল অরা পালায়ে গেল
        মমিনুলরে কইলাম মমিনুল কয় ঠিক কইসে আমিও সুনসি সাবাগে টেকা দেয় মমিনুলের রিস্কার হাওয়া ছাইরা দিসি কইলাম কাইলকা সাবাগ যাবি অইখানে টেকা দেয় রিস্কা চালাবি কেন

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, সোমবার
        একুসে ফেবরুয়ারি মহাসমাবেস অইব সবাইরে নিজের এলাকায় লুকজনে বুজাইতে কইসে সাবাগের কতা রাজাকারদের ফাসি চাই জয় বাংলা

২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, বুধবার
        দুইদিন সাবাগ যাই নাই না গুমায়া জর আইসিল কাহিল লাগে কাইলকা জর নিয়াই যামু একটা কালা পানজাবি কিনসি অইটা পরা যামু বউ ফন দিসিল বারি থাইকা আমারে কইল সাবদান থাকতে আমি কই বউ তুই চইলা আয় আমি তরে সাবাগ নিয়া যামু কত মানুস দেখবি সব বাই-বইনের মত বউ কিসু কয়না হাসে

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, বৃহস্পতিবার
        বিসাল সমাবেস অইসিল সবাই মিলা সহিদ মিনারে ফুল দিলাম সলুগান দিলাম পরে ঘুসনা দিল সাবাগে আর পরতেকদিন সমাবেস অইব না এখন থাইকা এলাকায় এলাকায় সমাবেস অইব সবাইরে নিজেগ এলাকায় কাজ করতে কইল আমি ঠিক করসি ঢাকা ছাইরা দিমু বারি যামু এলাকায় কাজ করতে বউরে ফন দিসি বউ খুব খুসি খালি হাসে

২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, রবিবার
        কাইল বারি যামু এই কয়দিন কিসু লিখতে পারি নাই দিনরাইত রিস্কা চালাইসি বারি যামু কিসু টেকা লাগব না? মামাত বাইয়ের লগে কতা অইসে এলাকায় অর চা মিসটির দুকান আসে আমি সামনে পান সিগারেটের দুকান দিয়া বইমু ভাল অইসে দুকানদারিও অইব সবার সাতে সাবাগ নিয়া কতাও কওন যাইব

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, সোমবার
        বারি আয়া পরসি অনেক কাজ দুকানের লাইগা জিনিসপাতি কিনতে অইবো দুকান বানাইতে অইব বউরে সারাদিন সাবাগের গলপ সুনাইসি হা কইরা সুনে

২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, বুধবার
        আমি দুকান দিয়া দিসি পরথম দিনই পান বিকরি অইসে পচিস টেকার চা বানাইসি চললিস কাপ কাইল নাকি সাইদির রায় দিব সবাই কইতাসে সরকার তারে ফাসি দিব না বাললাগতেসিল না দুকান বন্দ কইরা বারিত আয়া পরসি রাইতে তারাতারি ভাত খায়া বউরে জরায়া ধইরা শুয়া পরসি

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, বৃহস্পতিবার
আইজকা আমি খুব খুসি পান বিকরির টেকা দিয়া সবাইরে মিসট খাওয়াইসি সাইদির ফাসি হয়া গেসে আর চিনতা নাই সব রাজাকারের ফাসি অইব জয় বাংলা তয় পাসের গেরামের জামাতিরা রামদা চাপাতি লয়া আইসিল আমাদের গেরামের বাজারে আইসা সবাইরে দুকান বন্দ কইরা দিতে কইসে সবাই ভয়ে বন্দ কইরা দিসে আমি দেই নাই তর কতায় দুকান লাগামু? আমারে কইসে খবর আসে আমি কইসি বাল ছিরবা তুমরা

মার্চ, ২০১৩, শুক্রবার
        বাকি কথাটুকু আমাকেই বলতে হবে শরিফুলের আর সে ক্ষমতা নেই বেশী কিছু বলার নেই অল্প কথায় বলতে গেলে মার্চ, ২০১৩, শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শান্তিরাম ইউনিয়নের গংসারহাট বাজারে জামায়াত-শিবির কর্মীরা দোকান ভাংচুর শুরু করে ভয়ভীতি উপেক্ষা করে কয়েকজনকে নিয়ে বাধা দিতে যায় শরিফুল ইসলাম ধারালো অস্ত্রের মুখে বাকিরা জীবন নিয়ে পালিয়ে গেলে শরিফুলকে পাশের ধানক্ষেতে ফেলে পিটিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে তারা

ফেব্রুয়ারি, ২০৬৩, বুধবার
        আমার নাম দুর্জয় শরীফ, শরিফুল ইসলামের নাতি জামাতের হামলায় শরিফুল ইসলাম মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী, আমার দাদি প্রতিজ্ঞা করেন, নিজ হাতে হত্যার বদলা নিতে না পারলেও সন্তানকে প্রস্তুত করবেন যুদ্ধের জন্য শরিফুলের স্ত্রী মিনারা বেগম দিনমজুরির চাকির নেন ছেলে রফিকুলকে স্কুলে পাঠান এক বুক স্বপ্ন নিয়ে ছেলে তার স্বপ্ন পূরণ করে বড় হয়ে সে হয় দেশের অন্যতম সেরা পাইলট স্বপ্নটা ছেলের কাছে জমা দিয়ে স্বামীর কাছে চলে যান মিনারা ছেলেও ভুলেনি মা-বাবার কথা নিজের ছেলেকে শিক্ষা দেন নিজ হাতে স্কুলের পড়ার বাইরেও দেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়িয়ে রাজনীতিসচেতন করে তুলেন একমাত্র ছেলে দুর্জয়কে

প্রজন্ম চত্বর, যে জায়গাটির নাম একসময় শাহবাগ ছিল, সেখানে গেলেই শরীরে কেমন যেন এক শিহরণ বয়ে যায় বিশেষ করে দেশকে রাজাকারমুক্ত করতে গিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে চত্বরের ঠিক মাঝখানে যে অসাধারণ স্মৃতিসৌধটি স্থাপন করা হয়েছে, তা বিশ্বের অন্যতম সেরা ভাস্কর্যের তালিকায় স্থান পাবার দাবিদার দেশ আজ রাজাকারমুক্ত, সাম্প্রদায়িকতার থাবা থেকে স্বাধীন, দেশ থেকে জামাত-শিবির নামের দল তাদের দোসররা নিষিদ্ধ হয়েছে অনেক আগেই

আমি দুর্জয় আজ মুক্তিযুদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্রবিদ্যায় অনার্স পড়ছি গল্প লেখা আমার ধাতে নেই কিন্তু ক্লাসে ইতিহাসের ম্যাডাম এসে যখন বললেন প্রজন্ম দিবসের সুবর্ণ জয়ন্তীতে গল্প প্রতিযোগিতা হবে এবং বিজয়ী পাবে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে সোনার মেডেল, তখন খুব ইচ্ছে হলো কিছু লিখার না, মেডেলের জন্য নয় বাজারে কতোশত বই দেখি একজন সামান্য রিক্সাওয়ালা বলেই হয়তো, কে জানে, কোথাও দাদার নাম নেই তিনি যে অসীম সাহসের অবদান রেখে গেছেন, তা জানাও এই প্রজন্মের অধিকার তুমি জেনে খুশি হবে দাদু, তোমার স্বপ্ন আমরা পূরণ করেছি তোমাকে স্যালুট, জয় বাংলা
1 Response
  1. Shayantani Says:

    চমৎকার!!! এই গল্পটা তোমার লেখায় একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই গল্পটা ছিল তোমার লেখালেখির ক্যারিয়ারে একটা লং জাম্পের মতো। চালিয়ে যাও বস্।


Post a Comment