লাল রাজপুত্র
নতুন কিছু না। যে দেশের গল্প, সেই দেশেও আর সব দেশের মতো ছিল একটাই রাজা। আর সুয়োরাণী-দুয়োরাণী না, রাজার ছিল একটাই রাণী। রাজা আর রাণী মোটেও সুখে ছিলনা। তাদের দুজনের কিছুতেই মিলত না। কথায় কথায় শুধু ঝগড়া আর ঝগড়া। তাদের ঝগড়ায় ছিল সবাই অতিষ্ঠ। তবে গল্পটা রাজা-রাণীকে নিয়ে না। রাজা-রাণীর ছিল এক ছেলে, ফুটফুটে না, কুৎসিত দর্শন এক ছেলে। তবে তার ছিল খুব সুন্দর একটা মন (অন্ততঃ সে নিজে তাই ভাবত)। 

রাজপুত্রের নাম বলব না......ইচ্ছে করছে না। গল্পটা সেই রাজপুত্রকে নিয়েই।


রাজার ছেলে হওয়ায় রাজপুত্রের কোন বন্ধু ছিল না। সহজে কেউ তার কাছে ঘেঁষতো না। আর রাজা যে বদরাগী, কখন কি হয়ে যায় তার ঠিক আছে? তাই বেচারা রাজপুত্র খেলাধুলা তো দূরের কথা, কথা বলারই লোক পেতো না। এমনটা আর কতোদিন সহ্য হয়। রাজপুত্র একদিন প্রাসাদের কাউকে না বলে বের হলো ঘুরতে। গন্তব্য--যেদিক দুচোখ যায়। ঘুরতে ঘুরতে সে এসে হাজির হলো এক অদ্ভুত জায়গায়। পাহাড়ে ঘেরা এক বনে। বনের মধ্যে গাছের পাতার ফাঁক গলে গলে ঢুকে পড়ছে একটু একটু রোদ। প্রাসাদের চকমকে বাতির আলো দেখে দেখে রাজপুত্র ভুলতেই বসেছিল, প্রকৃতি কেমন হয়।


এমন সময় হঠাৎ দমকা হাওয়ার মতো হাসির শব্দ ভেঙ্গে দিল প্রকৃতির নীরবতা। না, অট্টহাসি নয়। পাতার ফাঁকের মিষ্ঠি রোদের মতোই এক চিলতে হাসি। কিসের টানে যেন রাজপুত্র ছুটে গেলো সেই হাসির উৎসের দিকে। বনের সবুজের মধ্যে আকাশ সমান ফুটফুটে এক ঝর্ণা, আর সেই ঝর্ণার পানিতে তার চেয়েও এক ফুটফুটে কণ্যা। সৌরজগতে সূর্যের আধিপত্য যেমন গ্রহরা আজীবন মেনে নিয়েছে, রোদকণ্যার শ্রেষ্ঠত্বও যেন তার চারপাশে স্নানরত অন্যরাও নতমস্তকেই স্বীকার করেছে। না, সে অপরূপ নয়, তবে তার চোখে কিসের যেন নেশা, গা থেকে ঠিকরে পড়ছে কিসের যেন আভা।

"কে তুমি কণ্যা?' রাজপুত্র জিজ্ঞেস করলো রোদকণ্যাকে। হঠাৎ এক পুরুষকে দেখে রক্ত ছলকে উঠলো কণ্যার মুখে। ঠিক যেন গোধুলীর রোদের মতো লাল। রাজপুত্রের মনে হলো সে যদি আরেকটু ফর্সা হতো, তারও গালে হয়তো এমন লালচে আভা আসতো। "তুমি কে?" পানি থেকে উঠে এসে পালটা প্রশ্ন বনকণ্যার। এভাবে এককথা-দু'কথা থেকে বেশ আলাপ জমে গেলো দুই জনের। দিন যায়, রাত যায়, দুজনের শুধু গল্প আর গল্প। সারা জীবনের সব না বলা কথা যেন রাজপুত্র প্রাণ খুলে বলতে লাগলো বনকণ্যাকে। কণ্যা এতো মনযোগ দিয়ে শুনতো কথাগুলো, মাঝে মাঝে কথার খেই হারিয়ে ফেলে রাজপুত্র ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো তার দিকে তাকিয়ে।

"ভালোবাসি", হঠাৎ একদিন রাজপুত্রের উপর বজ্রপাত করলো কণ্যা। "আমাকে?" নিশ্চিত হতে পারছিল না রাজপুত্র। "না, তোমাকে না, ঐ গাছে ঝুলছে যে বাদরটা, তাকে। আরে বাবা, আশেপাশে কি আর কেউ আছে যে তাকে বলবো?" রাজপুত্র অনেকক্ষণ ধরে বানরের দিকে তাকিয়ে থেকে বুঝতে পারলো না, তার মধ্যে কি আছে যা ঐ বানরের মধ্যে নেই? কি কারণে এমন কথা? যাই হোক, কারণ দিয়ে কি লাভ, রাজপুত্র ভাবলো। যেকথাটা অনেকদিন ধরে মনে মধ্যে ঘুরপাক খেলেও সাহস করে মুখ ফুটে বলতে পারেনি, তা আজ কণ্যা নিজে বলে দিল। নিজের জীবনে এর চেয়ে আনন্দের দিন রাজপুত্র অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলো না।

সময় এগিয়ে চললো বাতাসের গতিতে। নতুন যুগল জীবনের একা থাকা মূহুর্তগুলোকেও যেন উপভোগ করার চেষ্টায় নিজেরাই নিজেদের ছাড়িয়ে যাচ্ছিল বারবার। কিন্তু এরমধ্যেই হঠাৎ হঠাৎ কেমন যেন উদাস হয়ে যেতো কণ্যা। রাজপুত্র কোন কুলকিনারা খুঁজে পেলোনা। সে কি কোন কষ্ট দিয়েছে তার প্রিয়াকে? নাকি তার কোন অক্ষমতাই বনকলিকে এতো উদাস করে দেয়? সেই সময়গুলো খুব কষ্টে কাতে রাজপুত্রের। উদাস সময়টা কণ্যা যেন পাত্তাই দিতে চায় না রাজপুত্রকে। তবে এতোটাই ভালোবাসে সে কণ্যাকে, গাছের একটা পাতা পড়লেও কণ্যাকে সেটা না জানালে শান্তি পায়না পুত্র।


একদিন রাজপুত্র কণ্যার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে শান্তিতে। পৃথিবীর সব শান্তি যেন চুক্তি করে একসাথে থাকার পণ নিয়ে জড়ো হয়েছে কণ্যার শরীরে। হঠাৎ একটা আওয়াজ কানের কাছে শুনে চমকে উঠলো রাজপুত্র। কোত্থেকে আসছে এমন ভয়ংকর শব্দ? কণ্যার দিকে তাকিয়েই শরীর ঠান্ডা হয়ে গেলো তার। এ কি? কণ্যা কোথায়? তুমি কে? ডাইনী বুড়ির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে রাজপুত্র? নিজেকে অনেক ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারলো না। বিকটদর্শন সেই ডাইনীর কোলেই সংজ্ঞা হারালো সে। আসলেই কি সংজ্ঞা হারালো?

চোখ খুলতে না পারলেও কেমন যেন সবকিছু বাস্তবই মনে হচ্ছিল রাজপুত্রের। কিন্তু বুকটা হঠাৎ ভারী হয়ে গেলো কেন? ডাইনীটা কণ্যাকে কি করেছে? রাজপুত্রের নিশ্বাঃসও ভারী হয়ে আসলো। বুকে কিসের এতো ব্যাথা? আমার কণ্যা কোথায়? আবার দেখতে পাবে তো তার কণ্যাকে? অন্ততঃ একবারের জন্য? ঐ তো... মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে দুষ্টুমী ভরা চোখে একটা গাছের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের বনলতা। হায় হায়, এটা যে স্মৃতি। কণ্যাকে কাছে পাওয়ার আশায় ছটফট করতে থাকলো রাজপুত্র। কিন্তু ডাইনীর হাত থেকে কিছুতেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারলো না। 

দুমড়েমুচড়ে লাল হয়ে গেলো রাজপুত্র। একি সত্যি? নাকি স্বপ্ন? কণ্যার সেই স্মৃতির ছবিখানা নিয়েই কি কাটাতে হবে এমন করে? কোথায় আছে কণ্যা, কবে ফিরবে সে? কে বাঁচাবে ডাইনীর হাত থেকে? এর একটা প্রশ্নেরও উত্তর মেলে না। তবে যতো কষ্টই হোক, কণ্যার জন্য রইল অপেক্ষা। চোখের কোণা টলটল করে অঝোর ধারায় গাল বেয়ে পড়তে থাকলো...... না, এ তো অশ্রু নয়। চোখের জল কি কখনও লাল হয়?
0 Responses

Post a Comment